Sunday, June 12, 2011

JOYJOYONTIR SURJO / Jibanananda das

জয়জয়ন্তীর সূর্য

জীবনানন্দ দাশ

কোনো দিন নগরীর শীতের প্রথম কুয়াশায়
কোনো দিন হেমন্তের শালিখের রঙে ম্লান মাঠের বিকেলে
হয়তো বা চৈত্রের বাতাসে
চিন্তার সংবেগ এসে মানুষের প্রাণে হাত রাখেঃ
তাহাকে থামায়ে রাখে।
সে-চিন্তার প্রাণ
সাম্রাজ্যের উত্থানের পতনের বিবর্ণ সন্তান
হয়েও যা কিছু শুভ্র র’য়ে গেছে আজ-
সেই সোম-সুপর্ণের থেকে এই সূর্যের আকাশে-
সে-রকম জীবনের উত্তরাধিকার নিয়ে আসে।
কোথাও রৌদ্রের নাম-
অন্নের নারীর নাম ভালো ক’রে বুঝে নিতে গেলে
নিয়মের নিগড়ের হাত এসে ফেঁদে
মানুষকে যে-আবেগে যত দিন বেঁধে
রেখে দেয়,
যত দিন আকাশকে জীবনের নীল মরুভূমি মনে হয়,
যত দিন শূন্যতার ষোলো কলা পূর্ণ হয়ে- তবে
বন্দরে সৌধের ঊর্ধ্বে চাঁদের পরিধি মনে হবে,-
তত দিন পৃথিবীর কবি আমি- অকবির অবলেশ আমি
ভয় পেয়ে দেখি- সূর্য ওঠে;
ভয় পেয়ে দেখি- অস্তগামী।
যে-সমাজ নেই তবু র’য়ে গেছে, সেখানে কায়েমী
মরুকে নদীর মতো মনে ভেবে অনুপম সাঁকো
আজীবন গ’ড়ে তবু আমাদের প্রাণে
প্রীতি নেই- প্রেম আসে নাকো’।
কোথাও নিয়তিহীন নিত্য নরনারীদের খুঁজে
ইতিহাস হয়তো ক্রান্তির শব্দ শোনে, পিছে টানে;
অনন্ত গণনাকাল সৃষ্টি ক’রে চলে;
কেবলই ব্যক্তির মৃত্যু গণনাবিহীন হয়ে প’ড়ে থাকে জেনে নিয়ে- তবে
তাহাদের দলে ভিড়ে কিছু নেই- তবু
সেই মহাবাহিনীর মতো হতে হবে?

সংকল্পের সকল সময়
শূন্য মনে হয়
তবুও তো ভোর আসে- হঠাৎ উৎসের মতো, আন্তরিকভাবে;
জীবনধারণ ছেপে নয়,- তবু
জীবনের মতন প্রভাবে;
মরুর বালির চেয়ে মিল মনে হয়
বালিছুট সূর্যের বিস্ময়।
মহীয়ান কিছু এই শতাব্দীতে আছে,- আরো এসে যেতে পারেঃ
মহান সাগর গ্রাম নগর নিরুপম নদী;-
যদিও কাহারো প্রাণে আজ এই মরণের কালিমাকে ক্ষমা করা যাবে;
অনুভব করা যাবে স্মরণের পথ ধ’রে চ’লেঃ
কাজ ক’রে ভুল হলে, রক্ত হলে, মানুষের অপরাধ ম্যামথের নয়
কত শত রূপান্তর ভেঙে জয়জয়ন্তীর সূর্য পেতে হলে।

TAR STHIR PREMIKER NIKOT / Jibanananda das

তার স্থির প্রেমিকের নিকট

জীবনানন্দ দাশ

বেঁচে থেকে কোনো লাভ নেই,- আমি বলিনা তা।
কারো লাভ আছে;- সকলেরই;- হয়তো বা ঢের।
ভাদ্রের জ্বলন্ত রৌদ্রে তবু আমি দূরতর সমুদ্রের জলে
পেয়েছি ধবল শব্দ- বাতাসতাড়িত পাখিদের।
মোমের প্রদীপ বড়ো ধীরে জ্ব’লে- ধীরে জ্বলে আমার টেবিলে;
মনীষার বইগুলো আরো স্থির,- শান্ত,- আরাধনাশীল;
তবু তুমি রাস্তার বা'র হ’লে,- ঘরেরও কিনারে ব’সে টের পাবে নাকি
দিকে-দিকে নাচিতেছে কী ভীষণ উন্মত্ত সলিল।

তারি পাশে তোমারে রুধির কোনো বই- কোনো প্রদীপের মতো আর নয়,
হয়তো শঙ্খের মতো সমুদ্রের পিতা হ’য়ে সৈকতের পরে
সেও সুর আপনার প্রতিভায়- নিসর্গের মতোঃ
রূপ- প্রিয়- প্রিয়তম চেতনার মতো তারপরে
তাই আমি ভীষণ ভিড়ের ক্ষোভে বিস্তীর্ণ হাওয়ার স্বাদ পাই;
না হলে মনের বনে হরিণীকে জড়ায় ময়ালঃ

দন্ডী সত্যাগ্রহে আমি সে-রকম জীবনের করুণ আভাস
অনুভব করি; কোনো গ্লেসিয়র-হিম স্তব্ধ কর্মোরেন্ট পাল-
বুঝিবে আমার কথা; জীবনের বিদ্যুৎ-কম্পাস অবসানে
তুষার-ধূসর ঘুম খাবে তারা মেরুসমুদ্রের মতো অনন্ত ব্যাদানে।  

ANDHOKAAR / Jibanananda das

অন্ধকার

জীবনানন্দ দাশ

গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার ;
তাকিয়ে দেখলাম পাণ্ডুর চাঁদ বৈতরণীর থেকে তার অর্ধেক ছায়া
গুটিয়ে নিয়েছে যেন
কীর্তিনাশার দিকে ।

ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম--পউষের রাতে--
কোনোদিন আর জাগবো না জেনে
কোনোদিন জাগবো না আমি --কোনোদিন জাগবো না আর--

হে নীল কস্তুরী আভার চাঁদ,
তুমি দিনের আলো নও, উদ্যম নও, স্বপ্ন নও,
হৃদয়ে যে মৃত্যুর শান্তি ও স্থিরতা রয়েছে,
রয়েছে যে অগাধ ঘুম,
সে-আস্বাদ নষ্ট করবার মতো শেলতীব্রতা তোমার নেই,
তুমি প্রদাহ প্রবহমান যন্ত্রণা নও--
জানো না কি চাঁদ,
নীল কস্তুরী আভার চাঁদ,
জানো না কি নিশীথ,
আমি অনেক দিন--অনেক অনেক দিন
অন্ধকারের সারাৎসারে অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থেকে
হঠাৎ ভোরের আলোর মুর্খ উচ্ছাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব ব'লে
বুঝতে পেরেছি আবার,
ভয় পেয়েছি,
পেয়েছি অসীম দুনির্বার বেদনা;
দেখেছি রক্তিম আকাশে সূর্য জেগে উঠে
মানুষিক সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য
আমাকে নির্দেশ দিয়েছে ;
আমার সমস্ত হৃদয় ঘৃণায়--বেদনায়--আক্রোশে ভরে গিয়েছে ;
সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবী যেন কোটি কোটি শুয়োরের আর্তনাদে
উৎসব শুরু করেছে ।
হায়, উৎসব !
হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে
আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি, অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর
মতো মিশে থাকতে চেয়েছি ।

কোনোদিন মানুষ ছিলাম না আমি ।
হে নর, হে নারী ,
তোমাদের পৃথিবীকে চিনিনি কোনোদিন ;
আমি অন্য কোন নক্ষত্রের জীব নই ।
যেখানে স্পন্দন, সংঘর্ষ, গীত, যেখানে উদ্যম, চিন্তা, কাজ,
সেখানেই সূর্য , পৃথিবী, বৃহস্প্রতি, কালপুরুষ, অনন্ত আকাশগ্রন্থি,
শত শত শুকরীর প্রসব বেদনার আড়ম্বর ;
এইসব ভয়াবহ আরতি !


গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত ;
আমাকে জাগাতে চাও কেন ?

অরব অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠবো না আর ;
তাকিয়ে দেখবো না নির্জন বিমিশ্র চাঁদ বৈতরণীর থেকে
অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে
কীর্তিনাশার দিকে ।
ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকবো--ধীরে--পউষের রাতে
কোনোদিন জাগাবো না জেনে--
কোনোদিন জাগবো না আমি--কোনোদিন আর ।

Tuesday, June 7, 2011

HAI CHIL / Jibanananda das

হায় চিল

জীবনানন্দ দাশ

হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে!
তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে।
পৃথিবীর রাঙ্গা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;
আবার তাহারে কেন ডেকে আনো?
কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!

হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে!

GHORHA / Jibanananda das

ঘোড়া
জীবনানন্দ দাশ 

আমরা যাইনি মরে আজও- তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয় :
মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে;
প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন - এখনও ঘাসের লোভে চরে
পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর 'পরে।


আস্তাবলের ঘ্রাণ ভেসে আসে এক ভিড় রাত্রির হাওয়ায়;
বিষন্ন খড়ের শব্দ ঝরে পড়ে ইস্পাতের কলে;
চায়ের পেয়ালা ক'টা বেড়ালছানার মতো - ঘুমে-ঘেয়ো
                       কুকুরের অস্পষ্ট কবলে

হিম হয়ে নড়ে গেল ও-পাশের পাইস্-রেস্তরাঁতে,
প্যারাফিন-লন্ঠন নিভে গেল গোল আস্তাবলে।
                       সময়ের প্রশান্তির ফুঁয়ে;
এইসব নিওলিথ - স্তব্ধতার জ্যোৎস্নাকে ছুঁয়ে।

ADBHUT AANDHAAR EK ESECHHE E PRITHIBITE AAJ / Jibanananda das

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ

জীবনানন্দ দাশ

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশী আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজও মানুষের প্রতি,
এখনও যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাহাদের হৃদয়।

AAT BACHHOR AAGER EK DIN / Jibanananda das

আট বছর আগের এক দিন

 জীবনানন্দ দাশ


শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে - ফাল্গুনের রাতের আধাঁরে

যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ। বধূ শুয়ে ছিল পাশে - শিশুটিও ছিল;
প্রেম ছিল,আশা ছিল-জোৎসনায়,-তবে সে দেখিল
কোন ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেলো তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল - লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।
এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি!

রক্তফেনা-মাখা মুখে মড়কের ইদুঁরের মত ঘাড় গুজি
আধার ঘুজির বুকে ঘুমায় এবার;
কোনোদিন জাগিবেনা আর।

কোনোদিন জাগিবেনা আর।
জাগিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম - অবিরাম ভার
সহিবেনা আর -
এই কথা বলেছিলো তারে
চাঁদডুবে চ’লে গেলে - অদ্ভুদ আঁধারে
যেন তার জানালার ধারে
উটের গ্রীবার মতো কোন এক নিস্তব্ধতা এসে।

তবুও পেঁচা জাগে;
গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে।
আরেকটি প্রভাতের ইশারায় - অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে
টের পাই যুথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে
চারদিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা
মশা তার অন্ধকার সংগ্রামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালোবাসে

রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রোদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি;
সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কতো দেখিয়াছি।
ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন - যেন কোন বির্কীন জীবন
অধিকার ক’রে আছে ইহাদের মন;
চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বথের কাছে
একগাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা - একা,
যে জীবন ফড়িঙের,দোয়েলের-মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা
এই জেনে।

অশ্বথের শাখা
করেনি কি প্রতিবাদ ? জোনাকির ভিড় এসে
সোনালী ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে
করেনি কি মাখামাখি?
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা এসে
বলেনি কি; ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে
চমৎকার !
ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার!’
জানায়নি পেঁচা এসে এ-তুমুল গাড় সমাচার ?

জীবনের এই স্বাদ-সুপক্ক যবের ঘ্রান হেমন্তের বিকেলের-
তোমার অসহ্য বোধ হ’লো;
মর্গে কি হৃদয় জুড়ালো
মর্গে - গুমোটে-
থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে।
শোনো
তবু এ মৃতের গল্প; কোনো
নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই;
বিবাহিত জীবনের সাধ
কোথাও রাখেনি কোন খাদ,
সময়ের উদ্বর্তনে উঠে এসে বধু
মধু-আর মননের মধু
দিয়েছে জানিতে;
হাড়হাবাতের গ্লানি বেদনার শীতে
এ-জীবন কোনদিন কেঁপে ওঠে নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হ'য়ে শুয়ে আছে টেবিলের পরে।

জানি - তবু জানি
নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয় -
আর এক বিপন্ন বিষ্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে,
ক্লান্ত - ক্লান্ত করে;
লাশকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হ'য়ে শুয়ে আছে টেবিলের পরে।

তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি,আহা,
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা অশ্বত্থের ডালে বসে এসে,
চোখ পাল্টায়ে কয়: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে ?’
চমৎকার !
ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার-

হে প্রগাঢ় পিতামহী,আজো চমৎকার ?
আমিও তোমার মতো বুড়ো হবো-বুড়ি চাঁদটারে আমি
ক’রে দিবো কালীদহে বেনোজলে পার;
আমরা দুজনে মিলে শূন্য ক’রে চ’লে যাবো জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।