Pages

Sunday, March 6, 2011

EKGUCHCHHA KABITA / Tushar Choudhury

তুষার চৌধুরীর কবিতা 

[২০১১ সালের কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত শেষ কবিতার বই 'সময়মঞ্জীর' থেকে]


বাতিল পৃথিবী ছেড়ে

     বসন্ত ঋতুর যত আয়োজনই নষ্ট করো হু হু করে অর্দ্ধতৃপ্ত প্রেম
     সব ঝুলবারান্দায় খেলা করে কেশদাম আর ঘরে জননের ফুল

নতুন সৈকত জাগে নয়া চর বালি কড়ি ঝিনুক ও মাছের কঙ্কাল
বাতিল পৃথিবী ছেড়ে সমুদ্র যোজন দূরে চলে যেতে চায়
ওই দ্যাখো চমৎকার ঝলমলিয়ে জেগে উঠছে বন্দরশহর
পৃথিবী নারীর মতো। নিজেকে জানে না, শুধু লুঠ হয় প্রতারক হাতে
জাহাজ - অশ্লীল খোল - তারা ভরা রাতে
অনিকেত অন্ধকারে তরঙ্গলাঞ্ছিত জলে লাফ দেয় কবি
অর্থবহ বিবাহ কোথাও কবে ছিল নাকি মাংসের সমাজে

স্তব্ধ ও গোপন এক হিমবাহ মাথা তোলে

জলের অতলে
মৎস্যকন্যাদের পিছু নিয়েছিল যে সমস্ত কবি ও শফরী
তারা হারিয়ে গিয়েছে সব ঝাঁকড়াচুলো দুলন্ত শৈবালে
ছন্দ অলংকার নিয়ে যতদূর যায় যাক এরা সব
কবিতার মীনপুচ্ছ কোনওদিন নাগালে পাবে না
বিভ্রান্ত মানুষ যে যে সত্তায় জাগিয়ে তোলে সুরেলা কুহেলি
তুমি সেই সব শাঁকচুন্নিদের
হাতে হাতে ধরিয়েছ ম্লান চাঁপাফুল
উদ্ভিদরমণীদের বকুলফুলের মতো জলআয়না
রূপকথার স্নানঘর হর্ম্যরাজি থেকে
ভেসে আসছে কলস্বর রোকোকো সংগীত
অজানা বিষাদ থেকে পঞ্চরঙ্গী উপশম প্রার্থনা করেছ
পরীনির্বাণের নামে জলঘূর্ণীর মতো নীল শিশুর প্রস্রাব
ফুঁসে উঠছে, স্বর্গের কপাট খুলে খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে বিলোল অপ্সরা

কবিতার পাতা পোড়ে, পুড়ে যেতে থাকে, পুড়ে যায়
তোমার শরীরে হাঁটে গুবরে কি মখমল পোকা
অস্তিস্ত্ব ব্যাদান করে
জ্বলন্ত সুরঙ্গ থেকে ঈষদুষ্ণ ক্ষত থেকে সম্ভবত জরা
তোমাকে জড়ায়
যেসব নিপাট ভদ্রজন আছে এ তল্লাটে তাদের মানচিত্রে
তারা মৃৎশকটে ঘোরাফেরা করে
দিগন্তের চিহ্ন নেই ঋতু নেই গাছপালাও পাবে না এ দেশে
অন্তরীপে তোমার জাহাজ মৃত্যুকামী কবিদের নিয়ে সামান্য জিরোতে চেয়েছিল
বন্দরনারীর দেহে মাংসমেদমজ্জা নেই - তোমার হিমেল আলমারিতে
থরে থরে মাংস মাছ বিস্মৃতির উপাদেয় মদ
কচুরিপানার ফুল শাপলা পদ্মপাতা ফড়িঙের
হারানো পৃথিবী খুঁজে ফেরে

ঊষার অরুণ আলো গাছে গাছে সোনালি কিরণ
স্বরবর্ণ মুছে গিয়ে পড়ে আছে শুধুই ব্যঞ্জন
কবিতা - আনন্দ রাত্রি - লোপ পেয়ে ওঠে চড়া রোদ
সপ্তডিঙা ডুবে গেছে,
কতিপয় নাবিকের দীর্ঘশ্বাস শোনা যায় সমুদ্রবাতাসে
কঠোর জীবন তুমি চেয়েছিলে, জরায়ুজলের নভশ্চর
আজ তুমি কৃষ্ণ নদীটির অববাহিকায় নিমজ্জিত, মৃত।


পূর্ণতা

পূর্ণতার ফোঁটা ফোঁটা অন্ধকার সান্দ্র সানুদেশে ঝরে পড়ে
রাত্রি তিনপ্রহরে ডাকে মৃত্যুকাক
ঘুমের হিজল ছেয়ে হিজলের ফুল
স্বপ্নের সৈকতে ফেরে সমুদ্রময়াল
তুমি কি দ্যাখোনি ফুল ফুল্ল স্তন তরঙ্গের ছরছর ফেনা
কবন্ধের মতো তুমি ডুবে গেছ মাংসের কবরে

এইযে বৃষ্টির দিনে রামধনু জন্মান্ধ শামুক
এই যে নিষ্পাপ ডানা ফড়িঙের
       এরা সকলেই নানা রকমের পূর্ণতাসন্ধানী
ট্রেনের হুইসিল, তারও গন্তব্য রয়েছে
চুম্বন বোঁটার দুধ সুপ্ত অগ্নি এদেরও তো পরিণতি আছে

তোমার অঞ্চল তুমি নিজেই জানো না
উপদ্রুত নিদ্রার নির্জনে শুধু আততায়ী ত্রাস
তোমার স্বপ্নের দাম কানাকড়ি
মৃত্যুর প্রতীকে এত সূক্ষ্ম কারুকাজ
মৃত্যু এক যৌন প্রতিচ্ছবি
কিছুই পাওয়ার নেই চিতার ভস্মের মতো মসৃণতা ছাড়া

শিরাউপশিরা দিয়ে কামসূত্র দিয়ে
সেইসব মায়াতাঁবু একদা খাটানো হয়েছিল
হিম মালভূমি থেকে হাওয়া এসে সেসব উড়িয়ে নিয়ে গেছে
মনে হয়
পূর্ণতা নামের এক কারুকাম তোমাদের কঙ্কালের প্রত্নতা পেয়েছে


কবিতা লেখার আগে

কবিতা লেখার আগে কবিতার সঙ্গে অল্প সহবাস করো
গালগল্প কান্নাকাটি স্মৃতি বা বিস্মৃতি নয়
শব্দ আর নৈঃশব্দ্যের মধ্যেই কবিতা বাস করে

কবিতাকে দেরাজে খুঁজো না, কিম্বা ভুলেও আশকারা
                       দিতে যেও না, কবিতা
গর্ভিণী নারীর মতো নিদ্রাতুর নয়
বিষধর নাগিনীর মতো তার ফণা তুলে ধরে

কবি মরে তবুও তো কবি যায় ট্রামে
বেতালা মাতাল কোন দিশাহীন টার্মিনাসে আসে
প্রেমে বা অপ্রেমে নয় কবিতা কলমে লেখা হয়

কবিতা কী? আমি একটি পুতুল বানাই
পুতুলের সঙ্গে রঙ্গ করি
পুতুল আমার সঙ্গে দূরের শহরে যেতে চায়

ইঁদুরের চোখ দিয়ে দেখি আমি পুতুলের আকাশের তারা
কবিতাকে কেন রোজ হতে হবে প্রাতরাশ নৈশভোজ ঊরুর ইশারা


পালানো ও ফেরা

আমি কি পালিয়ে যাব এইবার জঙ্গল পাহাড়ে
কী ভাববে তাহলে এই হুল্লুড়ে নারকী শুঁড়িখানা
দূর থেকে চিঠি লিখব প্রেয়সীকে, কে প্রেয়সী - অন্ধকারে চেনা?
আমি কি আশ্রয় নেব এইবার স্বরবৃত্তে অথবা ছড়ায়?
সেডারের ছায়া ঘেরা হোটেলে এবার স্বেচ্ছানির্বাসন নেব।

ফিরে আসব কথা দিচ্ছি, ফিরে আসব কিছুদিন পর
ফিরে আমি কখনও আসব না
কেঁদো না কেঁদো না শব্দ বর্ণমালা না-লেখা কবিতা
আমাকে ঘিরেছে আজ স্বেচ্ছানির্বাসন
আমাকে ফেলেছে ঢেকে স্তূপাকার কাকের পালক।

কবিতাগুলি কবি  মিতুল দত্তর সৌজন্যে পাওয়া