Sunday, March 27, 2011

EKGUCHCHHA KABITA / Bhaskar Chakrabarty

একগুচ্ছ কবিতা

ভাস্কর চক্রবর্তী

 
















শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা

শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব- প্রতি সন্ধ্যায়

কে যেন ইয়ার্কি করে ব্যাঙের রক্ত
ঢুকিয়ে দেয় আমার শরীরে- আমি চুপ করে বসে থাকি- অন্ধকারে
নীল ফানুস উড়িয়ে দেয় কারা, সারারাত বাজি পোড়ায়
হৈ-হল্লা- তারপর হঠাৎ
সব মোমবাতি ভোজবাজীর মত নিবে যায় একসঙ্গে- উৎসবের দিন
হাওয়ার মত ছুঁতে যায়, বাঁশির শব্দ

আর কানে আসে না- তখন জল দেখলেই লাফ দিতে ইচ্ছে করে আমার

মনে হয়- জলের ভেতর- শরীর ডুবিয়ে
মুখ উঁচু করে নিঃশ্বাস নিই সারাক্ষণ- ভালো লাগে না সুপর্ণা, আমি
মানুষের মত না, আলো না, স্বপ্ন না- পায়ের পাতা
আমার চওড়া হয়ে আসছে ক্রমশঃ- ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনলেই
বুক কাঁপে, তড়বড়ে নিঃশ্বাস ফেলি, ঘড়ির কাঁটা
আঙুল দিয়ে এগিয়ে দিই প্রতিদিন- আমার ভালো লাগে না- শীতকাল
কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব

একবার ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই মেঘ ঝুঁকে থাকতে দেখেছিলাম

জানলার কাছে- চারদিক অন্ধকার
নিজের হাতের নখও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না সেদিন- সেইদিন
তোমার কথা মনে পড়তেই আমি কেঁদে ফেলেছিলাম- চুলে, দেশলাই জ্বালিয়ে
চুল পোড়ার গন্ধে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আবার-
এখন আমি মানুষের মত না- রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে
হঠাৎ এখন লাফ দিতে ইচ্ছে করে আমার- ভালোবাসার কাছে, দীর্ঘ তিনমাস
আর মাথা নীচু করে বসে থাকতে ভালো লাগে না- আমি
মানুষের পায়ের শব্দ শুনলেই
তড়বড়ে নিঃশ্বাস ফেলি এখন- যে দিক দিয়ে আসি, সে দিকেই দৌড় দি
কেন এই দৌড়ে যাওয়া? আমার ভালো লাগে না
শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব।

রক্ত


শুধু ফোটায় ফোঁটায় রক্ত ঝরে পড়ে রক্ত।

এক মুহূর্তের রক্ত
অন্য মুহূর্তের গায়ে ঝরে পড়ে।
...চশমা পরিষ্কার করে আমি ইতিহাস পড়ি।
ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত ঝরে পড়ে
বিছানার ওপর
রক্ত ঝরে পড়ে সমস্ত জীবন বেয়ে

কেন
 
কেন, উন্মাদ করে না ভালোবাসা-
আমি শুধু, নতুন
কাগজ কিনি-খালি গায়ে
ঘুরে বেড়াই ঘরের মধ্যে-চারপাশ
থেকে, কেশে ওঠে মানুষ-চারপাশ থেকে
কতশত ব্যর্থ দিন বহে গেল-
লাল মোটরগাড়িতে, আমার
হাসা হলো না-বিয়েবাড়িতে, যথাযথ
হাসা হলো না আমার-চিহ্ণহীন
বছরগুলো, ওই, পড়ে আছে পেছনে-প্রত্যেক
জানলার পর্দা সরিয়ে, আমি
বাড়িয়ে দিই মুখ-আমি দেখি
একটা দিন, আরেকটা দিনের মতো
আরেকটা দিন, আরেকটা দিনের মতো
একইরকম, অস্থিসার, ফাঁকা

স্মৃতি


পঁচিশ বছর আগেকার

মুখ যেন জাপানী অক্ষর

বাজুবন্ধ মৃদু বেজে ওঠে

গান গান গান শুধু গান

ছোট এক ঘরে শুয়ে আজ

মনে পড়ে প্রেমিক ছিলাম

জীবন-সংক্রান্ত
 
কোথাও সানাই বেজে চলেছে এখন
মানুষেরা বাড়ি ফিরছে সুখ-শান্তি চেয়ে।

আমি শুধু ঘুরি আর

ঘুরে মরি।
চেয়ে দেখি আমার জীবনে

শুধু রাস্তা পড়ে আছে- ধূ ধূ রাস্তা পড়ে আছে শুধু।



স্থিরচিত্র


গাছ আর

গাছের ছায়ার নিচে দড়ির খাটিয়া

আমাদের তৃতীয় পৃথিবী


মৃতসঞ্জীবনী


যদি ভালোবাসা, প্রিয়, আমাকে বাঁচাতে পারে বাঁচবো তাহলে-

খসে পড়া তারাগুলো নাহলে আমাকে নিয়ে
মৃত তারাদের দেশে চলে যাবে-
সেখানে সমাধি হবে আমারও বা
লেখা হবে, আজব বিচিত্র এক নীল তারা, চশমাধারী প্রজাপতি,
এখানে ঘুমোচ্ছে সারা জীবনের ঘুমে,
যে তারাটি একা একা ছাতে বসে বুঝতে চেয়েছিল
ভালোবাসা আজো কেন বিক্রি হবে চড়া দামে
ভালোবাসা, রাজারহাটের তিন বেডরুমের মোলায়েম ফ্ল্যাট নাকি কোনো?
শাদা কোনো টাটা সুমো?
হলুদ বালিতে যায় ভরে যায় দেশ-বিদেশ, যাকে তোমরা
মরুভূমি বলো
সে মরুবালিও পথ শুঁকে শুঁকে এসে গেছে আমাদের ঘরে
এসো তুমি ধবধবে বিছানায় দুঘন্টায় ধন্য হও পথের কুটীরে
তিন গ্লাস স্বাধীনতা সঙ্গে পাবে
শুধু তুমি, এখনো কেন যে ভাবো, ভালোবাসা
ভালোবাসা মৃতসঞ্জীবনী

দূরের টেবিল


এবার বয়স হলো। মাছরাঙাদের কথা কেন?


আমার, তাঁতের শাড়ি

ভালো লেগেছিল খুব ষাটের দশকে।

আরো ভালো লেগেছিল তাঁতের শাড়ির মহিলাকে।


অনেক বছর হলো সেইসব-

আজ কিছু ক্লান্ত, তবু ভালো লাগে যেই দেখি

একটি মেয়েকে ঘিরে চার-পাঁচজন বসে আছে

দূরের টেবিলে।


ভিখারি


মুখের চামড়া টান, লোকে বলে-‘গম্ভীর মানুষ, একলা ঘরের কোণে থাকে’-

কিসের গাম্ভীর্য? আহা, দু’তিনটে কবিতা লিখি বলে?
তুমি জানো, আমি শালা ভিখারির চেয়েও ভিখারি
সিঁড়ির তলায় জুতো ছেড়ে
তোমার নিরালা ঘরে উঠে যাই, নেমে আসি-মাঝখানে তুমি
চায়ের বাজার নিয়ে কথা বলো, কথা বলো এ-বছর কোথায় বা বেশি বৃষ্টিপাত
কোনো কোনো দিন হেসে চোখটা ওপরে তুলে, ‘আরে তুমি? এসো এসো
সেই কবে এসেছ সাতাশে’-
আমি দেখি চেয়ে, বোর্ণভিটা তোমাকে যত পুষ্টতা দিয়েছে
মুখরা করেছে তারও বেশি-

সকাল ন’টায় তবু টেলিফোন দেখলেই বুকের ভেতরে হাঁস ছটফট করে

কচি ছাগলের মতো রোদ নাচে ছাদের কার্নিশে-
সব কি মাটিতে যাবে?
একবার এই জন্ম-ছুটে যাই, তুমি জানো ছুটবই আমি
যেখানে তোমার ছায়া বসবই হাঁটু ভাঁজ করে
আমি ইঁট, আমি কাঠ-চূণ বালি অথবা খড়কে-কাঠি আমি
তুমি জানো, আমি শালা ভিখারির চেয়েও ভিখারি
বোকার মতন আজও হেসে
তোমার নিরালা ঘরে উঠে যাই, নেমে আসি, লোকে বলে-‘গম্ভীর মানুষ
একলা ঘরের কোণে থাকে’

শুধুমাত্র তোমাকে-৩


তোমার মাথার ওপর দিয়ে, দ্রুত, উড়ে গেল একটা এরোপ্লেন-

দূরে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি দেখি
কি বিশাল ছায়া পড়ল তোমার শরীরে-আর পাখিরা
এই উনিশশো একাত্তরেও ভয় পেল খুব-সত্যি
পাখির বিষয়ে আমরা কত কম জানি-গাছের বিষয়েও
আমরা বিশেষ কিছুই জানি না- এক একটা গাছের সঙ্গে
সারাজীবন থেকে যেতে ইচ্ছে করে-এক-হাজার পাখির মধ্যিখানে
বসে থাকতে ইচ্ছে করে দুপুরবেলা-সত্যি
দুপুরবেলা, আরও কত কি করতে ইচ্ছে করে- হলুদ শাড়ি পরে
যখন তুমি দাঁড়িয়ে থাক বারান্দায়

কবিতা ১২৯


আমার কোনো প্রিয় লেখক নেই। আমি

বই পড়ি, আর বই
বন্ধ করে দিই। দৌড়ে, ঝাঁপ দিয়ে
শুয়ে থাকি বিছানায়। আঃ,
বিছানাই হচ্ছে আমার চিরকালীন বন্ধু
আমার শান্তি, সান্ত্বনা, আর জীবনের পুরস্কার।
-বইয়ের তাকে, কত বই- কত লেখক!
কিন্তু কোথায় সেই লেখক
ওগো কোথায়
যাঁর চরিত্ররা শুধুই বিছানায় শুয়ে থাকে।


কবিতা ১৩৪

আমি দেখেছি ডানা ভাসিয়ে এগিয়ে আসছে মরুভূমি-

আমি দেখেছি বিষণ্ণ ট্রেন
আলো জ্বালিয়ে, ঝলমল, ছুটে যাচ্ছে জংশনের দিকে।
এবার যখন আবার ফিরে এলো ক্লান্তির দিন
তোমার অনুরোধে
আবার আমি চিঠি লিখতে শুরু করলাম তোমাকে।
-সেদিন, যখন চারিদিকে সন্ধে,
তোমার চিঠি আমি বিছানায় ছড়িয়ে পড়তে-পড়তে দেখি, আমার
ঘুম নামছে তোমার চিঠিপত্রের ওপর-
আমার ঘুমের ভেতরে
তুমি ঘুমিয়ে আছ, তোমার দিদিও ঘুমিয়ে আছে দেখি,
দেখি, আমার সমস্ত লেখালেখির ভেতর মৃত্যু তার ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। 

কবিতাগুলি type করে দিয়েছেন কবি তুহিন দাস