Friday, November 23, 2012

DUTI KABITA / Joy Goswami



জয় গোস্বামী 
********
রূপ 
.........
অসম্বৃত অবস্থায় দেখেছে রাত্রিকে 
সূর্য তাই এখন টানে রক্তগাঁজাদম 
সে বলে, ‘মন ঘুরিয়ে দেবো অন্য কারো দিকে-’ 
কিন্তু তার শক্তি বড় কম 

শক্তি কম, স্বাস্থ্য নেই – কোথায় ? কার কোলে 
দগ্ধ এই সূর্য তবে রাখবে পোড়া মাথা ? 
রাত্রি যদি আবারও তার কালো শরীর খোলে 
ফিনকি দিয়ে জ্বলবে সব পাতাঃ  
আগুন, পায়ে আগুন, শিরে আগুন – নিশ্চুপে 
পাতারা ওড়ে রাত্রি ভ’রে, পুরুষ ধ’রে খায় 
কী পাতা কেউ জানে না, শুধু সূর্য তার রূপে 
পাগল হয়ে নদীর জলে মাথা ডোবাতে যায় !  
***************************************     
সংহার 
.................
বগলা আমার জিভ টেনে ছিঁড়ছেন । এই জিভে 
আমি কত পাপ কথা গুপ্ত কথা অপরাধ কথা 
কী স্বপ্নে বলেছি , হায় ! কৃষ্ণরাই সীতারাম লক্ষ্মীনারায়ণ 
দুই মুহূর্তের ফাঁকে এক চক্ষু রেখে 
তোমাদের খোলা দেহ , মানবমানবীরূপে তোমাদের উদ্দাম মিলন 
দেখেছি , দেখিনি শুধু , হেসেছি – হাসিনি শুধু , পৃথিবীর ছাদে 
দশদিন দশরাত নৃত্য ক’রে বেড়িয়েছি – বেড়াইনি কেবল ,
                                           এক চুরমার ক্রোধে
হাওড়ার রাস্তায় আমি , বরাকর ব্রীজে আমি , নারকোলডাঙায় 
ফেলেছি প্রথম লাশ , ফেলেছি দ্বিতীয় লাশ , তিন চার , সহস্র অযুত 
উজ্জ্বল সোহম্ লাশ ফেলে আর ঘাড় ধ’রে এনেছি শিবের    
গদীতে , কৈলাসধামে , উপরে নিদ্রিত মহাদেব 
বাঁ পাশে ঘুমোন দুর্গা , দেয়ালে দেয়ালে দশপ্রহরণ ঝোলে চমৎকার 
কীভাবে আতঙ্কে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর , কীভাবে শবের গন্ধে 
                                    বমি হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর , সেই দৃশ্য দেখে  
আহ্লাদে আটখানা আমি , হ্যাঁ আমি মস্তিতে চুর , সত্যি আমি 
                            তুড়িলাফ আনন্দে খেয়েছি আমি সে-ফুর্তির প্রাণে 
গিয়েছি গড়ের মাঠে , আমি ও আমার জিভ গলিতে রাস্তায় পথে পথে 
এই পুণ্য ব্রতকথা প্রচার করেছি এই মদের দোকানে ওই 
                                        টগরের ঘরে সেই অন্ধ জেলকূপে   
মনের আনন্দে আমরা রাত ভোর দিয়েছি কীর্তন , সেই পাপে 
বগলা আমার জিভ উৎপাটন করছেন বগলা আমার 
জিভ টেনে ছিঁড়ছেন বগলা আমার জিভ ছাড়ো মরে যাচ্ছি ওয়াক্ থুঃ – 
ছাড়্ মাগী ডুবে যাচ্ছি , ছাড়্ রক্ত ডুবে রক্ত , হাড় রক্ত পুবে রক্ত 
                                           লাল রক্ত পুবে...আহ্ , মাগো......
জয় গোস্বামী 
রূপ 


অসম্বৃত অবস্থায় দেখেছে রাত্রিকে 
সূর্য তাই এখন টানে রক্তগাঁজাদম
সে বলে, ‘মন ঘুরিয়ে দেবো অন্য কারো দিকে-’
কিন্তু তার শক্তি বড় কম

শক্তি কম, স্বাস্থ্য নেই – কোথায় ? কার কোলে
দগ্ধ এই সূর্য তবে রাখবে পোড়া মাথা ?
রাত্রি যদি আবারও তার কালো শরীর খোলে
ফিনকি দিয়ে জ্বলবে সব পাতাঃ
আগুন, পায়ে আগুন, শিরে আগুন – নিশ্চুপে
পাতারা ওড়ে রাত্রি ভ’রে, পুরুষ ধ’রে খায়
কী পাতা কেউ জানে না, শুধু সূর্য তার রূপে
পাগল হয়ে নদীর জলে মাথা ডোবাতে যায় ! 



সংহার 


বগলা আমার জিভ টেনে ছিঁড়ছেন । এই জিভে
আমি কত পাপ কথা গুপ্ত কথা অপরাধ কথা
কী স্বপ্নে বলেছি , হায় ! কৃষ্ণরাই সীতারাম লক্ষ্মীনারায়ণ
দুই মুহূর্তের ফাঁকে এক চক্ষু রেখে
তোমাদের খোলা দেহ , মানবমানবীরূপে তোমাদের উদ্দাম মিলন
দেখেছি , দেখিনি শুধু , হেসেছি – হাসিনি শুধু , পৃথিবীর ছাদে
দশদিন দশরাত নৃত্য ক’রে বেড়িয়েছি – বেড়াইনি কেবল ,
এক চুরমার ক্রোধে
হাওড়ার রাস্তায় আমি , বরাকর ব্রীজে আমি , নারকোলডাঙায়
ফেলেছি প্রথম লাশ , ফেলেছি দ্বিতীয় লাশ , তিন চার , সহস্র অযুত
উজ্জ্বল সোহম্ লাশ ফেলে আর ঘাড় ধ’রে এনেছি শিবের
গদীতে , কৈলাসধামে , উপরে নিদ্রিত মহাদেব
বাঁ পাশে ঘুমোন দুর্গা , দেয়ালে দেয়ালে দশপ্রহরণ ঝোলে চমৎকার
কীভাবে আতঙ্কে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর , কীভাবে শবের গন্ধে
বমি হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর , সেই দৃশ্য দেখে
আহ্লাদে আটখানা আমি , হ্যাঁ আমি মস্তিতে চুর , সত্যি আমি
তুড়িলাফ আনন্দে খেয়েছি আমি সে-ফুর্তির প্রাণে
গিয়েছি গড়ের মাঠে , আমি ও আমার জিভ গলিতে রাস্তায় পথে পথে
এই পুণ্য ব্রতকথা প্রচার করেছি এই মদের দোকানে ওই
টগরের ঘরে সেই অন্ধ জেলকূপে
মনের আনন্দে আমরা রাত ভোর দিয়েছি কীর্তন , সেই পাপে
বগলা আমার জিভ উৎপাটন করছেন বগলা আমার
জিভ টেনে ছিঁড়ছেন বগলা আমার জিভ ছাড়ো মরে যাচ্ছি ওয়াক্ থুঃ –
ছাড়্ মাগী ডুবে যাচ্ছি , ছাড়্ রক্ত ডুবে রক্ত , হাড় রক্ত পুবে রক্ত
লাল রক্ত পুবে...আহ্ , মাগো.....














Thursday, November 8, 2012

KEU KATHA RAKHENI / Sunil Gangopadhyay


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
কেউ কথা রাখে নি

কেউ কথা রাখে নি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখে নি
ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমী তার আগমনী গান হঠা থামিয়ে বলেছিলো
শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে
তারপর কতো চন্দ্রভূক অমাবস্যা চলে গেলো,
কিন্তু সেই বোষ্টুমী আর এলোনা
পঁচিশ বছর প্রতীক্ষায় আছি

মামাবাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিলো, বড় হও দাদাঠাকুর
তোমাকে আমি তিনপ্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো
সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর
খেলা করে!
নাদের আলী, আমি আর কতো বড় হবো? আমার মাথা এ ঘরের ছাদ
ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায়
তিনপ্রহরের বিল দেখাবে?

একটাও রয়্যাল গুলি কিনতে পারি নি কখনো
লাঠি-লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্করবাড়ির ছেলেরা
ভিখারীর মতন চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি
ভিতরে রাস-উসব
অবিরল রঙের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কণ পরা ফর্সা রমণীরা
কত রকম আমোদে হেসেছে
আমার দিকে তারা ফিরেও চায় নি!
বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন, দেখিস, একদিন, আমরাও
বাবা এখন অন্ধ, আমাদের দেখা হয়নি কিছুই
সেই রয়্যাল গুলি, সেই লাঠি-লজেন্স, সেই রাস-উসব
আমায় কেউ ফিরিয়ে দেবেনা!

বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিলো,
যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালোবাসবে
সেদিন আমার বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ হবে!
ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠেয়ে প্রাণ নিয়েছি
দুরন্ত ষাড়ের চোখে বেঁধেছি লালকাপড়
বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীলপদ্ম
তবু কথা রাখে নি বরুণা, এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ
এখনো সে যে-কোনো নারী

কেউ কথা রাখে নি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখে না!

Tuesday, October 23, 2012

Thursday, August 30, 2012

KAYEKTI KABITA / Rudra Muhammad Shahidullah


















কয়েকটি কবিতা

রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ




এ কেমন ভ্রান্তি আমার


এ কেমন ভ্রান্তি আমার !
এলে মনে হয় দূরে স’রে আছো, বহুদূরে,
দূরত্বের পরিধি ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে আকাশ।
এলে মনে হয় অন্যরকম জল হাওয়া, প্রকৃতি,
অন্য ভূগোল, বিষুবরেখারা সব অন্য অর্থবহ-
তুমি এলে মনে হয় আকাশে জলের ঘ্রান।

হাত রাখলেই মনে হয় স্পর্শহীন করতল রেখেছো চুলে,
স্নেহ- পলাতক দারুন রুক্ষ আঙুল।
তাকালেই মনে হয় বিপরীত চোখে চেয়ে আছো,
সমর্পন ফিরে যাচ্ছে নগ্ন পায়ে একাকী বিষাদ- ক্লান্ত
করুণ ছায়ার মতো ছায়া থেকে প্রতিচ্ছায়ে।
এলে মনে হয় তুমি কোনদিন আসতে পারোনি..

কুশল শুধালে মনে হয় তুমি আসোনি
পাশে বসলেও মনে হয় তুমি আসোনি।
করাঘাত শুনে মনে হয় তুমি এসেছো,
দুয়ার খুল্লেই মনে হয় তুমি আসোনি।
আসবে বললে মনে হয় অগ্রিম বিপদবার্তা,
আবহাওয়া সংকেত, আট, নয়, নিম্নচাপ, উত্তর, পশ্চিম-
এলে মনে হয় তুমি কোনদিন আসতে পারোনি।

চ’লে গেলে মনে হয় তুমি এসেছিলে,
চ’লে গেলে মনে হয় তুমি সমস্ত ভূবনে আছো।

অভিমানের খেয়া
‘এতোদিন কিছু একা থেকে শুধু খেলেছি একাই
পরাজিত প্রেম তনুর তিমিরে হেনেছে আঘাত
পারিজাতহীন কঠিন পাথরে

প্রাপ্য পাইনি করাল দুপুরে,
নির্মম ক্লেদে মাথা রেখে রাত কেটেছে প্রহর বেলা_
এই খেলা আর কতোকাল আর কতোটা জীবন!
কিছুটা তো চাই- হোক ভুল হোক মিথ্যে প্রবোধ,
অভিলাষী মন চন্দ্রে না পাক, জ্যোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই
কিছুটা তো চাই, কিছুটা তো চাই।

আরো কিছুদিন, আরো কিছুদিন– আর কতোদিন?
ভাষাহীন তরু বিশ্বাসী ছায়া কতোটা বিলাবে?
কতো আর এই রক্ততিলকে তপ্ত প্রণাম!
জীবনের কাছে জন্ম কি তবে প্রতারণাময়?

এতো ক্ষয়, এতো ভুল জমে ওঠে বুকের বুননে,
এই আঁখি জানে, পাখিরাও জানে, কতোটা ক্ষরণ
কতোটা দ্বিধায় সন্ত্রাসে ফুল ফোটে না শাখায়

তুমি জানো নাই– আমি তো জানি
কতোটা গ্লানিতে এতো কথা নিয়ে, এতো গান, এতো হাসি নিয়ে বুকে
নিশ্চুপ হয়ে থাকি

বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে বলি এই তো জীবন,
এইতো মাধুরী, এই তো অধর ছুঁয়েছে সুখের সুতনু সুনীল রাত।

তুমি জানো নাই– আমি তো জানি
মাটি খুঁড়ে কারা শষ্য তুলেছে,
মাংসের ঘরে আগুন পুষেছে
যারা কোনোদিন আকাশ চায়নি নীলিমা চেয়েছে শুধু,
করতলে তারা ধরে আছে আজ বিশ্বাসী হাতিয়ার

পরাজয় এসে কণ্ঠ ছুঁয়েছে লেলিহান শিখা,
চিতার চাবুক মর্মে হেনেছো মোহন ঘাতক
তবুও তো পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে মুখর হৃদয়,
পুষ্পের প্রতি প্রসারিত এই তীব্র শোভন বাহু।

বৈশাখী মেঘ ঢেকেছে আকাশ
পালকের পাখি নীড়ে ফিরে যায়–
ভাষাহীন এই নির্বাক চোখ চোখ আর কতোদিন?
নীল অভিমানে পুড়ে একা আর কতোটা জীবন?
কতোটা জীবন?’

‘কিছুটা তো চাই– হোক ভুল হোক মিথ্যে প্রবোধ,
অভিলাষী মন চন্দ্রে না পাক, জ্যোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই
কিছুটা তো চাই, কিছুটা তো চাই… ‘

এক গ্লাস অন্ধকার হাতে
এক গ্লাস অন্ধকার হাতে নিয়ে বসে আছি।
শুন্যতার দিকে চোখ, শুন্যতা চোখের ভেতরও–
এক গ্লাস অন্ধকার হাতে নিয়ে বসে আছি।
বিলুপ্ত বনস্পতির ছায়া, বিলুপ্ত হরিণ।
মৌসুমী পাখির ঝাঁক পালকের অন্তরালে
তুষারের গহন সৌরভ ব’য়ে আর আনে না এখন।

দৃশ্যমান প্রযুক্তির জটাজুটে অবরুদ্ব কাল,
পূর্ণিমার চাঁদ থেকে ঝ’রে পড়ে সোনালী অসুখ।
ডাক শুনে পেছনে তাকাই– কেউ নেই।
এক গ্লাস অন্ধকার হাতে নিয়ে বসে আছি একা….
সমকালীন সুন্দরীগণ অতিদ্রুত উঠে যাচ্ছে
অভিজাত বেডরুমে,
মূল্যবান আসবাবপত্রের মতন নির্বিকার।
সভ্যতা তাকিয়ে আছে তার অন্তর্গত ক্ষয়
আর প্রশংসিত পচনের দিকে।

উজ্জ্বলতার দিকে চোখ, চেয়ে আছি–
ডীপ ফ্রিজে হিমায়িত কষ্টের পাশেই প্রলোভন,
অতৃপ্ত শরীরগুলো খুঁজে নিচ্ছে চোরাপথ– সেক্সড্রেন।

রুগ্নতার কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা বিলাচ্ছে অপচয়–
মায়াবী আলোর নিচে চমৎকার হৈ চৈ, নীল রক্ত, নীল ছবি

জেগে ওঠে একখন্ড ধারালো ইস্পাত–চকচকে,
খুলির ভেতরে তার নড়াচড়া টের পাই শুধু।

ইতিমধ্যে ককটেলে ছিন্নভিন্ন পরিচয়,সম্পর্ক,পদবী–
উজ্জ্বলতার ভেতরে ফণা তুলে আর এক ভিন্ন অন্ধকার।
গ্লাসভর্তি অন্ধকার উল্টে দিই এই অন্ধকারে।

কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প
তাঁর চোখ বাঁধা হলো।
বুটের প্রথম লাথি রক্তাক্ত করলো তার মুখ।
থ্যাতলানো ঠোঁটজোড়া লালা-রক্তে একাকার হলো,
জিভ নাড়তেই দুটো ভাঙা দাঁত ঝরে পড়লো কংক্রিটে।
মা…..মাগো….. চেঁচিয়ে উঠলো সে।

পাঁচশো পঞ্চান্ন মার্কা আধ-খাওয়া একটা সিগারেট
প্রথমে স্পর্শ করলো তার বুক।
পোড়া মাংসের উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো ঘরের বাতাসে।
জ্বলন্ত সিগারেটের স্পর্শ
তার দেহে টসটসে আঙুরের মতো ফোস্কা তুলতে লাগলো।

দ্বিতীয় লাথিতে ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে গেলো দেহ,
এবার সে চিৎকার করতে পারলো না।

তাকে চিৎ করা হলো।
পেটের ওপর উঠে এলো দু’জোড়া বুট, কালো ও কর্কশ।
কারণ সে তার পাকস্থলির কষ্টের কথা বলেছিলো,
বলেছিলো অনাহার ও ক্ষুধার কথা।

সে তার দেহের বস্ত্রহীনতার কথা বলেছিলো-
বুঝি সে-কারণে
ফর ফর করে টেনে ছিঁড়ে নেয়া হলো তার সার্ট।
প্যান্ট খোলা হলো। সে এখন বিবস্ত্র, বীভৎস।

তার দুটো হাত-
মুষ্টিবদ্ধ যে-হাত মিছিলে পতাকার মতো উড়েছে সক্রোধে,
যে-হাতে সে পোস্টার সেঁটেছে, বিলিয়েছে লিফলেট,
লোহার হাতুড়ি দিয়ে সেই হাত ভাঙা হলো।
সেই জীবন্ত হাত, জীবন্ত মানুষের হাত।

তার দশটি আঙুল-
যে-আঙুলে ছুঁয়েছে সে মার মুখ, ভায়ের শরীর,
প্রেয়সীর চিবুকের তিল।
যে-আঙুলে ছুঁয়েছে সে সাম্যমন্ত্রে দীক্ষিত সাথীর হাত,
স্বপ্নবান হাতিয়ার,
বাটখারা দিয়ে সে-আঙুল পেষা হলো।
সেই জীবন্ত আঙুল, মানুষের জীবন্ত উপমা।
লোহার সাঁড়াশি দিয়ে,
একটি একটি করে উপড়ে নেয়া হলো তার নির্দোষ নখগুলো।
কী চমৎকার লাল রক্তের রঙ।

সে এখন মৃত।
তার শরীর ঘিরে থোকা থোকা কৃষ্ণচূড়ার মতো
ছড়িয়ে রয়েছে রক্ত, তাজা লাল রক্ত।

তার থ্যাতলানো একখানা হাত
পড়ে আছে এদেশের মানচিত্রের ওপর,
আর সে হাত থেকে ঝরে পড়ছে রক্তের দুর্বিনীত লাভা-

মনে পড়ে সুদূরের মাস্তুল

পেছনে তাকালে কেন মূক হয়ে আসে ভাষা !
মনে পড়ে সেই সব দুপুরের জলাভূমি,
সেই সব বেতফল, বকুল কুড়ানো ভোর,
আহা সেই রাঙাদির আঁচলতলের উত্তাপ,
মনে পড়ে…….

মনে পড়ে, বন্দরে সেই সব কালোরাত,
ঈগলের মতো ডানা সেই বিশাল গভীর রাতে,
একটি কিশোর এসে চুপি চুপি সাগরের কূলে
দাঁড়াতো একাকী
তন্ময় চোখে তার রাশি রাশি বিস্ময় নিয়ে।

কবে তারে ডাক দিয়ে নিয়ে গেলো যৌবন সুচতুর,
কবে তারে ডেকে নিলো মলিন ইটের কালো সভ্যতা !

সবুজ ছায়ার নিচে ঘুমে চোখ ঢুলে এলে
মা যাকে শোনাতো সেই তুষারদেশের কথা,
তার চোখে আজ এতো রাতজাগা ক্লান্তির শোক !

পেছনে তাকালে কেন নিরবতা আসে চোখে !
মনে পড়ে- জ্যোৎস্নায় ঝলোমলো বালুচর,
একটি কিশোর- তার তন্ময় দুটি চোখে
রাশি রাশি কালোজল- সুদূরের মাস্তুল
মনে পড়ে…..

Sunday, July 15, 2012

HARIN / Bitashok Bhattachryya

হরিণ  
বীতশোক ভট্টাচার্য

কে তুমি আজ হরিণ, যাও, সঘনস্রোতে গগনে
তারা ছিটোও ; অদেখা খুর, শাণিত রুপো, অরণি
ও শিঙে জ্বলে ; কোথায় জল ? পায়ের তলে ধরণী
সরাও, আর হরিণ ধাও । সোনার কণা নয়নে

সোনার কণা শরীরে আরও ; এত অনল, হরিণী
নিলয় পায় তবে কোথায় ! কোথাও, কার চরণে
হিরণহার ছিঁড়ে লুটোয়, যা তুমি গেলে আমি নিই
মালায় গেঁথে -- বরণ কী এই রশ্মি খরকিরণে ।

Friday, June 22, 2012

SARARAT JAGA SOMUDRO / Pinaki Thakur


e bachhor tnar notun kabitar boier jonyo ANANDA PUROSKAR pelen kabi PINAKI THAKUR.
aamader shuvechchha.  
puroskar peye kabir prathomik protikriya : 
ei puroskarer madhyome bangla kabitar ekta projonmoke sommanito kora holo

Saturday, May 12, 2012

STHIRCHITRA / Bhaskar Chakrabarty,

স্থিরচিত্র
ভা স্ক র চ ক্র ব র্তী


গাছ আর
গাছের ছায়ার নীচে দড়ির খাটিয়া

আমাদের তৃতীয় পৃথিবী

Saturday, May 5, 2012

SADHARON MEYE / Rabindranath Tagore

সাধারণ মেয়ে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
আমি অন্তঃপুরের মেয়ে,
            চিনবে না আমাকে।
তোমার শেষ গল্পের বইটি পড়েছি, শরৎবাবু,
               ‘বাসি ফুলের মালা'।
তোমার নায়িকা এলোকেশীর মরণ-দশা ধরেছিল
               পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে।
পঁচিশ বছর বয়সের সঙ্গে ছিল তার রেষারেষি,
        দেখলেম তুমি মহদাশয় বটে —
               জিতিয়ে দিলে তাকে।
  
 
     নিজের কথা বলি।
বয়স আমার অল্প।
      একজনের মন ছুঁয়েছিল
                 আমার এই কাঁচা বয়সের মায়া।
           তাই জেনে পুলক লাগত আমার দেহে —
    ভুলে গিয়েছিলেম, অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে আমি।
আমার মতো এমন আছে হাজার হাজার মেয়ে,
        অল্পবয়সের মন্ত্র তাদের যৌবনে।
      
 
        তোমাকে দোহাই দিই,
একটি সাধারণ মেয়ের গল্প লেখো তুমি।
           বড়ো দুঃখ তার।
        তারও স্বভাবের গভীরে
অসাধারণ যদি কিছু তলিয়ে থাকে কোথাও
           কেমন করে প্রমাণ করবে সে,
        এমন কজন মেলে যারা তা ধরতে পারে।
কাঁচা বয়সের জাদু লাগে ওদের চোখে,
        মন যায় না সত্যের খোঁজে,
    আমরা বিকিয়ে যাই মরীচিকার দামে।
    

কথাটা কেন উঠল তা বলি।
        মনে করো তার নাম নরেশ।
সে বলেছিল কেউ তার চোখে পড়ে নি আমার মতো।
    এতবড়ো কথাটা বিশ্বাস করব যে সাহস হয় না,
           না করব যে এমন জোর কই।
   
 
একদিন সে গেল বিলেতে।
           চিঠিপত্র পাই কখনো বা।
    মনে মনে ভাবি, রাম রাম! এত মেয়েও আছে সে দেশে,
           এত তাদের ঠেলাঠেলি ভিড়!
        আর তারা কি সবাই অসামান্য —
               এত বুদ্ধি, এত উজ্জ্বলতা।
    আর তারা সবাই কি আবিষ্কার করেছে এক নরেশ সেনকে
           স্বদেশে যার পরিচয় চাপা ছিল দশের মধ্যে।
  
 
  গেল মেলের চিঠিতে লিখেছে
           লিজির সঙ্গে গিয়েছিল সমুদ্রে নাইতে —
        বাঙালি কবির কবিতা ক' লাইন দিয়েছে তুলে
           সেই যেখানে উর্বশী উঠছে সমুদ্র থেকে —
                তার পরে বালির ‘পরে বসল পাশাপাশি —
    সামনে দুলছে নীল সমুদ্রের ঢেউ,
               আকাশে ছড়ানো নির্মল সূর্যালোক।
        লিজি তাকে খুব আস্তে আস্তে বললে,
    ‘এই সেদিন তুমি এসেছ, দুদিন পরে যাবে চলে;
           ঝিনুকের দুটি খোলা,
               মাঝখানটুকু ভরা থাক্‌
        একটি নিরেট অশ্রুবিন্দু দিয়ে —
           দুর্লভ , মূল্যহীন। '
        কথা বলবার কী অসামান্য ভঙ্গি।
সেইসঙ্গে নরেশ লিখেছে, ‘কথাগুলি যদি বানানো হয় দোষ কী,
           কিন্তু চমৎকার —
হীরে-বসানো সোনার ফুল কি সত্য, তবুও কি সত্য নয়। '
            বুঝতেই পারছ
একটা তুলনার সংকেত ওর চিঠিতে অদৃশ্য কাঁটার মতো
     আমার বুকের কাছে বিঁধিয়ে দিয়ে জানায় —
           আমি অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে।
    মূল্যবানকে পুরো মূল্য চুকিয়ে দিই
        এমন ধন নেই আমার হাতে।
    ওগো, নাহয় তাই হল,
        নাহয় ঋণীই রইলেম চিরজীবন।
 
 
পায়ে পড়ি তোমার, একটা গল্প লেখো তুমি শরৎবাবু,
        নিতান্তই সাধারণ মেয়ের গল্প —
যে দুর্ভাগিনীকে দূরের থেকে পাল্লা দিতে হয়
        অন্তত পাঁচ-সাতজন অসামান্যার সঙ্গে —
           অর্থাৎ, সপ্তরথিনীর মার।
বুঝে নিয়েছি আমার কপাল ভেঙেছে,
        হার হয়েছে আমার।
কিন্তু তুমি যার কথা লিখবে
        তাকে জিতিয়ে দিয়ো আমার হয়ে,
           পড়তে পড়তে বুক যেন ওঠে ফুলে।
    ফুলচন্দন পড়ুক তোমার কলমের মুখে।
     
 
  তাকে নাম দিয়ো মালতী।
           ওই নামটা আমার।
           ধরা পড়বার ভয় নেই।
    এমন অনেক মালতী আছে বাংলাদেশে,
           তারা সবাই সামান্য মেয়ে।
               তারা ফরাসি জর্মান জানে না,
                   কাঁদতে জানে। কী করে জিতিয়ে দেবে।
    উচ্চ তোমার মন, তোমার লেখনী মহীয়সী।
        তুমি হয়তো ওকে নিয়ে যাবে ত্যাগের পথে,
            দুঃখের চরমে, শকুন্তলার মতো।
               দয়া কোরো আমাকে।
           নেমে এসো আমার সমতলে।
        বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাত্রির অন্ধকারে
দেবতার কাছে যে অসম্ভব বর মাগি —
            সে বর আমি পাব না,
কিন্তু পায় যেন তোমার নায়িকা।
    রাখো-না কেন নরেশকে সাত বছর লণ্ডনে,
        বারে বারে ফেল করুক তার পরীক্ষায়,
           আদরে থাক্‌ আপন উপাসিকামণ্ডলীতে।
        ইতিমধ্যে মালতী পাস করুক এম . এ .
               কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে,
        গণিতে হোক প্রথম তোমার কলমের এক আঁচড়ে।
           কিন্তু ওইখানেই যদি থাম
তোমার সাহিত্যসম্রাট নামে পড়বে কলঙ্ক।
    আমার দশা যাই হোক
        খাটো কোরো না তোমার কল্পনা।
    তুমি তো কৃপণ নও বিধাতার মতো।
মেয়েটাকে দাও পাঠিয়ে য়ুরোপে।
    সেখানে যারা জ্ঞানী, যারা বিদ্বান, যারা বীর,
           যারা কবি, যারা শিল্পী, যারা রাজা,
            দল বেঁধে আসুক ওর চার দিকে।
জ্যোতির্বিদের মতো আবিষ্কার করুক ওকে —
           শুধু বিদুষী ব'লে নয়, নারী ব'লে।
ওর মধ্যে যে বিশ্ববিজয়ী জাদু আছে
    ধরা পড়ুক তার রহস্য, মূঢ়ের দেশে নয় —
        যে দেশে আছে সমজদার, আছে দরদি,
               আছে ইংরেজ জর্মান ফরাসি।
মালতীর সম্মানের জন্য সভা ডাকা হোক-না, বড়ো বড়ো নামজাদার সভা।
মনে করা যাক সেখানে বর্ষণ হচ্ছে মুষলধারে চাটুবাক্য,
        মাঝখান দিয়ে সে চলেছে অবহেলায় —
               ঢেউয়ের উপর দিয়ে যেন পালের নৌকো।
        ওর চোখ দেখে ওরা করছে কানাকানি,
সবাই বলছে ভারতবর্ষের সজল মেঘ আর উজ্জ্বল রৌদ্র
           মিলেছে ওর মোহিনী দৃষ্টিতে।
( এইখানে জনান্তিকে বলে রাখি
           সৃষ্টিকর্তার প্রসাদ সত্যই আছে আমার চোখে।
               বলতে হল নিজের মুখেই,
        এখনো কোনো য়ুরোপীয় রসজ্ঞের
                সাক্ষাৎ ঘটে নি কপালে। )
        নরেশ এসে দাঁড়াক সেই কোণে,
    আর তার সেই অসামান্য মেয়ের দল।
         
 
            আর তার পরে?
তার পরে আমার নটেশাকটি মুড়োল,
        স্বপ্ন আমার ফুরোল।
           হায় রে সামান্য মেয়ে!
               হায় রে বিধাতার শক্তির অপব্যয়!